ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ, ঢাকা *
দেশে দ্রত শিল্পের বিস্তার ঘটছে। এর সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানদেশে দ্রত শিল্পের বিস্তার ঘটছে। এর সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।
ফলে শ্রম আইন ও বিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের তাগিদ এখন যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী। এর কারণ হল- আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা, ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা, দেশীয় আইনের শর্ত ইত্যাদি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬, এতে ২০১৩ সনে আনা সংশোধনী, এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ গৃহীত হওয়ার পর এ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, বিতর্ক এখন যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী।
সময়ের বাস্তবতায় শ্রম আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনকে যথাযথভাবে বুঝতে পারা ও তার প্রয়োগ এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী দরকার।বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যা বেশী আলোচনায় আসে তার মধ্যে অন্যতম হল কে শ্রমিক, আর কে তা নয়। এর কারণও রয়েছে- শ্রমিকের সংগে তার ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শিল্প-বিরোধের নিষ্পত্তি ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট।
এবার দেখা যাক বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ শ্রমিকের কি সংজ্ঞা দিয়েছে। উক্ত আইনের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে-
শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তার চাকরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এর মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রধানতঃ প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
আমরা এই সংজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করলে পাই, সেই শ্রমিক হবেন যিনি-
(১) শিক্ষাধীনসহ কর্মরত কোন ব্যক্তি;
(২) চাকরীর শর্ত থাকবে- যা প্রকাশ্য বা উহ্য হতে পারে, অর্থাৎ লিখিত কিংবা অলিখিত হতে পারে;
(৩) সরাসরি কিংবা কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন। (তবে স্থায়ী পদে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ করা যাবেনা);
(৪) যে কাজ করবেন তার জন্য মজুরী বা অর্থ পাবেন;
(৫) ব্যক্তি দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরি- যে কোন ধরণের কাজ করতে পারেন।
এই সংজ্ঞার শর্ত মোতাবেক, কেউ প্রধানতঃ (যদি প্রধান কাজ হয়) প্রশসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হলে তিনি শ্রমিক হবেন না।
তবে উপরের যে সংজ্ঞা তা সাধারণ সংজ্ঞা। এর সহজীকরণ সহজ নয়- অর্থাৎ কারও পদবী দেখেই আপনি সিদ্ধান্ত টানতে পারবেন না যে তিনি শ্রমিক হবেন কিংবা হবেন না।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের অসংখ্য সিদ্ধান্তে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। (একই বিষয়ে ভারতের হাই কোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টের অসংখ্য সিধান্ত রয়েছে, যে গুলো আমাদের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক)।
এসব মামলায় যে বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত এসেছে, তার সারমর্ম হল-
শুধুমাত্র কারও পদবী দেখে বলা যাবেনা যে কোন ব্যক্তি শ্রমিক অথবা মালিক কোন সংজ্ঞার আওতায় পড়বেন। এইক্ষেত্রে দেখতে হবে তার কাজের প্রকৃতি কি- তার পদের ক্ষমতার বিস্তার কতটা।
আমাদের উচ্চ আদালত এক মামলার রায়ে বলেছেন, কেউ তত্বাবধানের কাজে নিয়োজিত (Supervisory function) থাকলেও বলা যাবে না যে তিনি শ্রমিক নন। কোন ব্যক্তির কাজ যে ব্যবস্থাপনামূলক অথবা প্রশাসনিক তা বলা যাবে না যদি না তিনি অন্য কারও কাজ নিয়ন্ত্রণ অথবা তত্বাবধান করার ক্ষমতা না পেয়ে থাকেন। [Dosta Tex. Mills vs. S. B. Nath, 40 DLR (AD) (1988) 45 (50)].
আরেক মামলায় দেখা গেছে, একজনের পদবী প্রডাকশন ম্যানেজার হওয়া সত্বেও তিনি শ্রমিক বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন। [Managing Director, Contiforms Forms Limited vs. Labour Appellate Tribunal, Dhaka 50 DLR (1998) 476 (482)].
সাম্প্রতিক এক মামলার রায়ে আমাদের উচ্চ আদালত বলেছেন, কোন ব্যক্তি তত্বাবধানমূলক কাজ করতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত না হয়ে তা করেন তা হলে তিনি শ্রমিক। [19 BLC (2014) 472 (488)].
আদালতের এমনও সিধান্ত আছে যে, টেকনিশিয়ান-কাম-ডিজাইনারও শ্রমিকের সংজ্ঞায় পড়েছেন।
ব্যাখ্যাঃ
যেমনটি বলা হয়েছে, কারও পদবী দেখে বলা যাবে না যে তিনি শ্রমিক কিংবা শ্রমিক নন। এক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হবে- তার কাজের বিবরণী (Job Description), প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, এবং তিনি যে ব্যবস্থাপনামূলক কিংবা প্রশাসনিক কাজ করার জন্য খমতাপ্রাপ্ত তার প্রামাণিকরণ এবং তার প্রয়োগ করার প্রমানাদি। আর এক্ষেত্রে সরলীকরণ সহজ নয়। ব্যক্তি ভেদে (Case to Case) তা দেখতে হবে।
[নোটঃ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ২(৬৫) ধারায় যে সংজ্ঞা তা শ্রমিকের সাধারণ সংজ্ঞা। ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প-সম্পর্কের (শ্রম আইনের ত্রয়োদশ অধ্যায়) ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত।
উপরে উল্লেখিত ২(৬৫) ধারার বাইরেও (শিল্প বিরোধ সম্পর্কে কোন কার্যক্রমের প্রয়োজনে) লে-অফ, ছাঁটাই করা, ডিসচার্জ করা বা বরখাস্ত করা অথবা অন্য কোনভাবে চাকরী থেকে অপসারন করা কোন শ্রমিকও শ্রমিক-সংজ্ঞার আওতায় আসবে। তবে কোন প্রতিষ্ঠানের পাহারাদার অথবা নিরাপত্তা স্টাফ, অগ্নি-নির্বাপক স্টাফের কোন সদস্য এবং গোপনীয় সহকারী এর অন্তর্ভুক্ত হবেনা। (শ্রম আইন, ধারা ১৭৫)।]
পরামর্শ ও বিশ্লেষণঃ ড. উত্তম কুমার দাস, এলএল.এম. (যুক্তরাষ্ট্র), পিএইচ.ডি. (আইন), এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ; শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ। ই-মেইলঃ uttamdas.law@gmail.com
সহায়তায়ঃ দি লইয়ারস, ফোনঃ ০১৭৭৪ ০৪৪৬১০; ই-মেইলঃ thelawyersbd@gmail.com;