আইনজীবীর রোজনামচাঃ
শ্রমিকের সংজ্ঞা ও প্রসঙ্গ কথা (Lawyer’s diary: Definition of worker and related story)
ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেটঃ
গত মে মাসের প্রথম দিন একটি পোস্ট আমার নজর কাড়ে। একজন “দায়িত্বশীল” ব্যক্তি পোস্টটি দিয়েছিলেন।
তাঁর পোস্টের মর্মকথা ছিল- দেশের একটি “বিশেষ পেশা”র লোকজনের অধিকার রক্ষার জন্য কোন আইন নেই। তাই একটি নতুন আইন করতে হবে। ভাল কথা! যে কেউ যে কোন বিষয়ে নতুন আইন দাবী করতেই পারেন!
তবে আইনের একজন শিক্ষার্থী (দেশে ও বিদেশে) এবং বর্তমানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাজীবী হিসেবে আমার উপলব্ধি হ’ল- নতুন কোন আইন দাবী করার আগে সঠিকাভাবে বোঝা দরকার- বিদ্যমান আইনের পরিধি ও প্রয়োগ কি। তার সম্ভবনা কিংবা চ্যালেঞ্জ কি কি প্রভৃতি।
বিষয়টি নিয়ে আগেও একাধিকবার লিখেছি, আবারও লিখছি। কারণ দেখছি- বিদ্যমান অজ্ঞতা এবং উদাসীনতা কারও জন্য ফলদায়ক নয়। বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
আমি শ্রম আইনের কথা বলছি। যার পুরো নাম- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬; যা ২০০৬ সনের ৪২ নং আইন এবং ২০১৩ সনে সর্বশেষ সংশোধিত।
অনেকের ধারণা- শ্রম আইন শ্রমিকের জন্য আইন কিংবা শ্রমিকের অধিকারের জন্য করা একটি আইন! আসলে তা নয়।
শ্রম আইন অনেকগুলো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে, যার একটি হ’ল শ্রমিকের অধিকার। একই সঙ্গে এই আইন মালিকের অধিকারও নিশ্চিত করে। যেমন মালিক চাইলে বিনা-নোটিশে (নোটিশ-পে দিয়ে) কোন শ্রমিকের চাকরীর অবসান করতে পারেন (শ্রম আইন, ২৬ ধারা)।
শ্রম আইন কি কি বিষয় বিবেচনা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি তা আইনের ভূমিকায়ই বলা রয়েছে। সে গুলো হ’ল শ্রমিকের নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরীর হার নির্ধারণ, মজুরীর পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প-বিরোধ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকরীর অবস্থা ও পরিবেশ, শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট শ্রম আইন কি কি বিষয় বিবেচনা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি তা আইনের ভূমিকায়ই বলা রয়েছে। সে গুলো হ’ল শ্রমিকের নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরীর হার নির্ধারণ, মজুরীর পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প-বিরোধ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকরীর অবস্থা ও পরিবেশ, শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়।
এতেই নিহিত যে শ্রম আইনের ব্যাপ্তি কতটা। আর নামেই এর তাৎপর্য নিহিত; আইনের নাম কিন্তু শ্রম আইন; শ্রমিক আইন নয়।মজুরী বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করাই শ্রমিক হওয়ার মূল শর্তের অন্যতম।
শ্রম আইনের অন্ততঃ চার জায়গায় শ্রমিকের সংজ্ঞা রয়েছে; সেগুলো হ’লঃ (ক) ধারা ২(৬৫)- যা শ্রমিকের মৌলিক সংজ্ঞা দিয়েছে; যা মূলতঃ নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। (খ) ধারা ১৭৫- যা কারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন সে সম্পর্কিত শ্রমিকের সংজ্ঞা। (গ) ধারা ১৫০ তৎসহ চতুর্থ তফসিল- কারা কর্মস্থলে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের আওতায় পড়বেন তা সংজ্ঞায়িত করছে। (ঘ) ধারা ২৩৪- সেখানে শ্রমিককে লভ্যাংশের সুবিধাভোগী হিসেবে সজ্ঞায়িত করেছে।
আমাদের এখানে অনেকের মধ্যে ধারণা- যারা বেশী বেতন পান বা কথিত “মিড-লেভেল ম্যানেজার” তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোন আইন-কানুন নেই। বিষয়টি সঠিক নয়। যারা সরকার নিয়ন্ত্রিত দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারা বাদে সকলের নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলী নিয়ন্ত্রিত হবে শ্রম আইনের আওতায়।
শ্রম আইনে [বিশেষতঃ ২(৬৫) ধারা] শ্রমিকের যে সংজ্ঞাই থাকুক না কেন আমাদের মাননীয় উচ্চ আদালতে থেকে এই ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট রায় ও নির্দেশনা রয়েছে। কিছু প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ মামলা থেকে সারমর্ম হ’ল-
(i) A person who on being employed does any skilled, unskilled, manual, technical, trade promotional or clerical work for hire or reward, whether the term of employment be expressed or implied [Managing Director, Rupali Bank Limited vs. Md. Nazrul Islam Patwary and others. (1996) 48 DLR (AD) 62].
(ii) A worker when on very solitary occasion does the function of a Manager or an Administrative Officer does not cease to be a worker [Indo Pakistan Corporation Ltd. vs. Frist Labour Court of East Pakistan, 21 DLR 285].
(iii) What is important in determining whether a person is a “worker” or not is to see the main nature of the job done by him/her and not so much his/her designation [Mujibur Rahman Sarker vs. Labour Court, Khulna (1981) 31 DLR 301].
(iv) Mere designation is not sufficient to indicate whether a person is a worker or an employer, but it is nature of work showing the extent of authority, which determines whether he/she is a worker or an employer. A person does not cease to be worker only because he/she is employed in a Supervisory capacity. To be able to say that he/she is not a worker it has to be established that he/she exercises functions mainly of a managerial or administrative nature [Dosta Text. Mills vs. Sudhansu Bikash Nath (1988) 40 DLR (AD) 45].
তাই দেখা যাচ্ছে, পদবি দেখে নয়, বরং সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির কাজের ধরণ দেখে ঠিক হবে তিনি শ্রমিক কি-না। আর তা নির্ধারণ করবেন আদালত- তা সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও প্রেক্ষাপট দেখে। কারও নিয়োগকারী যদি দাবী করেন যে তিনি শ্রমিক নন, অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে সুবিধা পাবেন না তা হলে তাকেই (মালিক) তা প্রমাণ করতে হবে।
এখানে শ্রমিকের সংজ্ঞার তাৎপর্য হ’ল এর সঙ্গে আপনার নিয়োগের শর্তাবলী, চাকরীর সমাপনী-সুবিধাদি প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (সে শ্রমিক বা মালিক যেই হোক না কেন) কাজ হ’ল নিজে কোন সমস্যায় পড়লে এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পেশাজীবীর (এইক্ষেত্রে আইনজীবী) সহায়তা নেয়া।
শ্রমিকপক্ষের অধিকার আদায়ে আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি- ক্ষতিগ্রস্ত হলে আপনি যদি যথাসময়ে এবং যথানিয়মে পদক্ষেপ নিতে পারেন, একটি উপযুক্ত নোটিশেও আপনার কাজ হতে পারে।
আরেকটি কথা- অনেকে আইনী প্রক্রিয়া, মামলা-মোকদ্দমা এসব এড়িয়ে চলতে চান। আমিও তাই বলবো। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকলে? আমরা কখন ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে যাই!
অনেক সময় আইন- বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জুজুর ভয় দেখানো হয়। মামলা করা মানে এই নয় যে আপনাকে দৈনিক আদালতে ধর্না দিতে হবে।
ধরুন কাউকে বে-আইনিভাবে চাকরীচ্যুত করা হ’ল। তাঁকে যদি বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিতেই হয়, বড়জোর ১ থেকে ২ বার আইনজীবীর কাছে এবং ২ থেকে ৩ বার আদালতে যেতে হবে। আর এমন একটি মামলা এক থেকে দু’ বছরে শেষ হতে পারে। এই সময় আপনি অন্য চাকরী, ব্যবসা সবই করতে পারেন। অনেক দক্ষ আইনজীবী এখন ই-মেইলে কাজ সারেন।
আর খরচ- তা নাগালের মধ্যেই হওয়ার কথা। অনেক আইনজীবী (ব্যাক্তির অবস্থা বিবেচনায়) এবং প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে বিনা খরচে আইনী সহায়তা দেয়া।
অনেকে চুক্তি আইনের দোহাই দেন। নিয়োগ-সংক্রান্ত চুক্তির মূল নীতি হ’ল এহেন চুক্তিতে নিয়োগ ও সুবিধার কোন শর্ত প্রচলিত কোন আইন কিংবা জননীতির চেয়ে কম হতে পারবে না। আমাদের এখানে বেসরকারী খাতে চাকরীর নুন্যতম মানদণ্ড হ’ল শ্রম আইন। তাই এর শর্ত থেকে রেহাই নেই।
আমাদের এখানে কেউ কেউ “মিড-লেভেল ম্যানেজারদের” জন্য আলদা আইনের স্বপ্ন দেখেন। আমাদের এখনকার বাস্তবতায় আমি এখনই তার কোন সম্ভবনা বা প্রয়োজন দেখিনা। আমাদের পাশের দেশ ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কা এখনও সে পথে যায়নি। তারা এখন কারখানা আইন, শিল্প-বিরোধ আইন, ট্রেড ইউনিয়ন আইন প্রভৃতি দিয়ে চলছে। সেগুলো আমাদের শ্রম আইনের পূর্বসূরি।
আমাদের শ্রম আইনের ভাল দিল হ’ল- ২৫ টি আইনকে এক মলাটে আনা হয়েছে। আর খারাপ দিক হ’ল- তা করতে যেয়ে যথাযথ সমন্বয় হয়নি। ফলে অধ্যায়ে অধায়ে বিষয় ও বিধানের সংঘর্ষ রয়েছে। এই জট খোলার জন্য শ্রম বিধিমালা করা হলেও তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা আরও বেড়েছে। এসব দিকে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ কম। বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে মাথা-ব্যাথা নেই। সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেই।
আইনের কিছু বিষয় নিয়ে স্পষ্টতা আনয়ন ও নির্দেশনার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। আমাদের এখানে সে প্রবণতা কম। যারা আইনের কথিত ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারাও অনেক সময় নিরপেক্ষ নন, কোননা কোন পক্ষ সংশ্লিষ্ট (সরকার, মালিক ও শ্রমিক)। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখাকারীর জ্ঞান-গরিমা ও অভিজ্ঞতার অভাব এবং পক্ষপাত-দুষ্টটার কারণে তাঁদের ব্যাখা সার্বজনীন হয়না। হয় গোষ্ঠীগত মতামত।
আরেকটি কথা, অনেকে আমার কাছে বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স চান। যারা আইনজীবী (পেশায়যুক্ত) তারা জানবেন, দেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ বিভিন্ন ল’ রিপোর্টে প্রকাশিত হয়; সে গুলো হ’ল- ঢাকা ল’ রিপোর্ট (ডিএলআর), বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস (বিএলডি), বাংলাদেশ লিগ্যাল টাইমস (বিএলটি) প্রভৃতি। অনেক সময় অন্য দেশের রায়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
তবে এই ক্ষেত্রে বলবো- একটি বা দুটি রায় দেখে তেমনটা বোঝা যাবে না। দেখতে হবে কোন বিষয়ের ধারাবাহিকতা এবং আপনার ঘটনার প্রেক্ষাপট।
এই ক্ষেত্রে একটি ঘটনা মনে পড়লো। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব মিনেসোটায় আইনে মাস্টার্স করছি (২০০৯-২০১০)। আমাদের কোর্সের অংশ হিসেবে একটি আদালতে নেওয়া হ’ল। বিচার কার্যক্রম দেখার জন্য। (আমাদের সৌভাগ্য যে ফুলব্রাইট বৃত্তিধারী হিসেবে মাননীয় বিচারক এক পর্যায়ে আমাদের সঙ্গে কথা বললেল, প্রশ্ন করারও সুযোগ দিলেন)।
তো সেদিন একটি খুনের ঘটনার উপর সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছিল। একটি বারের রাতের ঘটনা। সিসিটিভিতে ধারণ করা ফুটেজের ভিত্তিতে প্রথমে প্রসিকিউশনপক্ষ (বাদী) ব্যাখা করছিলেন- আমার মনে হচ্ছিল ঐ পক্ষের আইনজীবী যা বলছিলেন তাই তো ঠিক!
কিন্তু একটু পর আমি ধন্ধে পড়লাম। প্রতিপক্ষের আইনজীবী একই ফুটেজ দেখিয়ে যা বলা শুরু করলেন তা পুরো উল্টো। উনি উনার সুবিধামত ভিডিও আগ-পিছ করছিলেন কিংবা থামাচ্ছিলেন। যা আগের জনের সঙ্গে মিল ছিলোনা। মনে হ’ল- উনার ব্যাখাও তো ঠিক!
এই কথা বলার উদ্দেশ্য হ’ল- আপনি রোগে পড়লে আপনার রোগ নিয়ে পড়াশোনা করার চেয়ে দ্রুত একজন দক্ষ ডাক্তারের (এক্ষেত্রে আইনজীবী) কাছে যাওয়া দরকার। তিনিই আপনাকে পথ দেখাবেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব, এর সঙ্গে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই)।
ড. উত্তম কুমার দাস, এলএল.এম. (যুক্তরাষ্ট্র), পিএইচ.ডি. (আইন)। তিনি মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ- এর এডভোকেট এবং শ্রম আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী। তিনি ফুল ব্রাইট বৃত্তির অধীনে ইউনিভারসিটি অব মিনেসোটা থেকে তাঁর দ্বিতীয় মাস্টার্স (আইনশাস্ত্র) করেছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পেশাগত মাস্টার্স করছেন। ই-মেইলঃ ukdas1971@gmail.com;